Oct 1, 2011

Collected : ভুল থেকে শেখা (পর্ব-২)


পজিশন সাইজিং
=========

মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে জুতা হারিয়ে আসার ঘটনা আমাদের দেশে বিরল নয়। আমাদের কেউ কেউ হয়তো এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে থাকতে পারি। জগত সংসারের সমস্ত কিছু ভুলে যখন আমরা সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে মশগুল হই, তখনই এই অকস্মাৎ ঘটনা ঘটে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত। হায়রে চোর!!! নামাজও পড়তে দিবি না ঠিকমত? এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি যিনি হয়েছেন নামাজে দাঁড়ানোর পর তার মনে যদি এই চিন্তা উঁকি দেয় তাহলে তো আর নামাজই হলনা ঠিকমত। তাহলে উপায়? উপায় অবশ্যই আছে। কেউ কেউ জুতা হারানোর ভয়ে জুতা হাতে নিয়েই মসজিদে ঢুকে যান, কেউবা আবার জুতায় নিজের নাম লিখে রাখেন বা চিহ্ন দিয়ে রাখেন বা অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। আমি একটা উপায় বলে দিতে পারি (হাস্যকর শোনাতে পারে) , জুতা রাখার যে বক্স আছে সেখানে ২ বক্সে যদি ২ টা জুতা রাখা যায় তাহলে কেমন হয়? চোরের কি অত সময় আছে ২ বক্স থেকে ২ টা জুতা খুঁজে চুরি করবে?

কি মনে ধরলো আইডিয়াটা?

ব্যবসা মানেই ঝুঁকি। আর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ? সেখানে তো ঝুঁকি আরো বেশি। তাই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আমার সব মূলধন যদি এক শেয়ারে খাটাই তাহলে আমি খুব বেশি লাভবান হতে পারি, আবার খুব বেশি লোকসানের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারি। ঝুঁকি কমানোর একটা কৌশল হল পজিশন সাইজিং। অর্থাৎ আপনি যে সব শেয়ারে টাকা খাটাবেন (পজিশন নেবেন)  তার আকার (সাইজ) নির্ধারণ করে দেওয়া। তাহলে আমরা বলতে পারি শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ের আকার নির্ধারণের পদ্ধতিই হচ্ছে পজিশন সাইজিং। পজিশন সাইজিং এর ব্যাখ্যায় আমি খুব সহজভাবে লেখার চেষ্টা করবো। কোন সংজ্ঞা, সূত্র, তত্ব -কোন কিছুতে যাবোনা। বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করাই হল মূলকথা, আমরাতো আর মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে যাচ্ছি না।


পজিশন সাইজিং এর সারকথা হল "সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে নেই"। সহজ উপায় হল আপনার মূলধনকে কয়েকটি সমান ভাগে ভাগ করে ঝুঁকিকে ভাগ করে দেওয়া। যেমন আপনার মূলধন যদি ৩০ লক্ষ টাকা হয় তাহলে তাকে (৪* ৭.৫ লাখ) বা (৫* ৬ লাখ) বা (৬*৫ লাখ) অথবা যুক্তিসঙ্গত ভাগে ভাগ করে দেওয়া। এভাবে মূলধণ ভাগ করে দেওয়ার অর্থ হল আমরা আমাদের ঝুঁকিকে ভাগ করে দিলাম, কোন একটি শেয়ারের দাম হঠাৎ অনেক বেশি পড়ে গেলে তা যেন পুরো মূলধনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।

একটা শেয়ার আমরা তখনই কিনি যখন এটা থেকে লাভের সম্ভাবনা দেখা যায়। প্রত্যেক ব্যবসায়ই একটা প্রত্যাশিত লাভ সবাই আশা করেন, বাস্তবে তা থেকে কিছু কম বা বেশি হতে পারে। একইভাবে প্রত্যেক শেয়ারেরই একটি প্রত্যাশিত মূল্য আছে যা থেকে হয়তো সামান্য কম বা বেশি হতে পারে। শেয়ার কেনার সময় আমাদের একটা বিষয় মাথায় রাখতে হয়, তা হলঃ এই শেয়ারের দাম কত পর্যন্ত কমতে পারে। সেভাবেই আমরা আমাদের ঝুঁকি মিনিমাইজ করে থাকি। ধরে নিচ্ছি, আমার ৩০ লাখ টাকার মধ্যে আমি ৫ টি সেক্টরে ৬ লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করবো। একটি সেক্টরে (যেমন প্রকৌশল খাতে) আমি ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করবো এবং এই ৬ লাখ টাকা আমি ১ টি শেয়ারে বিনিয়োগ করবো। ধরে নিচ্ছি আফতাব অটোমোবাইল এখন ক্রয়যোগ্য অবস্থায় আছে। সর্বশেষ (২৯/০৯/২০১১) ক্লোজ প্রাইস ২৪০ টাকা এবং আমি ৪টি পৃথক পজিশনে ( অর্থাৎ ৪ বারে ) এই শেয়ার ক্রয় করবো। মার্কেট লট হচ্ছে ৫০ টি।  প্রতি লটের দাম হচ্ছে (২৪০*৫০) বা ১২০০০ টাকা, তাহলে ৬ লক্ষ টাকা দিয়ে আমি (৬০০০০০/১২০০০) বা ৫০ লট কিনতে পারি। তাহলে আমার প্রত্যেক পজিশনের আকার হচ্ছে ১২.৫ লট, অর্থাৎ আমি প্রতিবারে ১২ বা ১৩ লট করে ক্রয় করবো। একবারে কেনার চেয়ে কয়েকবারে কিনলে আমার ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমছে। এবার আসুন এই শেয়ার থেকে আমরা কতটুকু লস দিতে রাজি আছি তা দেখি। এই শেয়ারের সর্বশেষ সাপোর্ট লেভেল ২৩২ , এখন আমি যদি ২৩২ কে স্টপ লস পয়েন্ট ধরি তাহলে আমার লস হচ্ছে ৩.৩৩% + ১% কমিশন= ৪.৩৩% । এটা হচ্ছে আমার রিস্ক এমাউন্ট, যদি এই শেয়ার তার সাপোর্ট ব্রেক করে তাহলে আমি শুধু রিস্ক এমাউন্ট ই লস করছি। এর বেশি না। এভাবে পজিশন সাইজ করে আমরা আমাদের ঝুঁকি কমাতে পারছি। সংক্ষেপে বিষয়টা আবার দেখিঃ

১। মোট মূলধনকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আমরা ঝুঁকি ভাগ করে দিলাম
২। প্রত্যেক ভাগ একেকটি সেক্টরে ভাগ করে ঝুঁকিকে আরো বিভাজিত করলাম
৩। প্রত্যেক সেক্টরে শেয়ার কেনার সময় কয়েকবারে কিনে ঝুঁকি আরো বিভাজিত করলাম।
৪। পূর্ববর্তী সাপোর্ট লেভেলকে স্টপ লস পয়েন্ট ধরে, সাপোর্ট লেভেল ক্রস করলেই এই শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে কেবল রিস্ক এমাউন্টই লস করলাম।


উপরের যে উদাহরণটা দিলাম তা হচ্ছে টেকনিক্যাল স্টপ লস এর মাধ্যমে পজিশন সাইজিং এর একটি উদাহরণ। এটা খুব সহজ এবং সরল ধারণা।

পজিশন সাইজিং কি এতই গুরুত্বপূর্ন???

হ্যাঁ। প্রত্যাশিত মাত্রার ঝুঁকি নিয়ে পজিশন সাইজ করে আপনি আপনার ভীতির (Fear) মাত্রা কমাচ্ছেন, ভুলের মাত্রা কমাচ্ছেন, বাজারের গতিপ্রকৃতি ভালোভাবে বুঝতে পারছেন এবং আপনার লেনদেন আচরণে (Trade behaviour) গুণগত পরিবর্তন আনতে পারছেন। কি ধরণের গুনগত পরিবর্তন? আপনার মধ্যে লুকিয়ে ছিলো পুঁজি হারানোর ভয় এবং লাভ হারানোর শংকা, এখন আপনি প্রত্যাশিত মাত্রার লস মেনে নিয়ে ট্রেড করে নিজেকে শঙ্কামুক্ত রাখতে পারবেন। আপনার কেনা দাম থেকে শেয়ারের দাম বাড়তে থাকলে আগের সাপোর্টের উপরে নতুন স্টপ লস পয়েন্ট ধরবেন। (স্টপ লস বিষয়ে আরেকটি বিস্তারিত লেখা প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে)। যথার্থ পজিশন সাইজ আপনাকে কোয়ালিটি ট্রেডার হিসেবে গড়ে তুলবে, আপনার ভীতি কমে আসবে, আপনার আস্থা বাড়বে।

যথার্থ পজিশন সাইজ কিভাবে করবো???

এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। আপনি যদি ক্যাশ একাউন্টে বিনিয়োগ করে থাকেন তাহলে এক রকম, মার্জিন একাউন্টে করে থাকলে আরেক রকম, তবে মোদ্দা কথা হল আপনার কত টুকু ঝুঁকি সহ্য করার ক্ষমতা আছে  (Tolerance of risk) তার উপর ভিত্তি করে পজিশন সাইজ করবেন। উদাহরণস্বরুপঃ আপনি যদি মার্জিন একাউন্টে ট্রেড করেন এবং আপনার বিনিয়োগ যদি ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ সহ মোট ৩০ লক্ষ টাকা হয় তাহলে আপনার ঝুঁকির মাত্রা হচ্ছে ( স্টপ লস + কমিশন+ ঋণের সুদ) অর্থাৎ প্রায় ৬%, আবার আপনার শেয়ারের দাম  ৪০% পড়ে গেলে আপনি মার্জিন কলের শিকার হবেন, আর ৫০% পড়ে গেলে আপনি ফোর্স সেল এর শিকার হবেন। এক্ষেত্রে আপনার ৬% এর বেশি তে স্টপ লস এ যাবার কোন সুযোগ নেই।

বিয়ার মার্কেট এর পজিশন সাইজ কেমন হতে পারে???

টমাস বুলকাউস্কি (Thomas Bullkowski) এ ব্যাপারে একটা ধারণা দিয়েছেন এ রকমঃ বাজার ১৯% পর্যন্ত ফল করলে কিছু না করে অপেক্ষা করা, ২০-২৯% ফল করলে ৫০% মূলধন তুলে ফেলা অর্থাৎ পজিশন সাইজ অর্ধেক করে ফেলা, ৩০-৩৯% ফল করলে পজিশন আরো অর্ধেক কমিয়ে ফেলা ( ২৫% পজিশন রাখা), ৪০% এর বেশি পড়লে আরো অর্ধেক কমিয়ে ফেলা (১২.৫% পজিশন রাখা)। আমাদের বাজার পরিস্থিতিতে পজিশন সাইজ এমন হতে পারেঃ ১০% ফল করলে ৫০% পজিশন ক্লোজ, ২০% ফল করলে  আরো ২৫% পজিশন ক্লোজ (মোত ৭৫% ক্লোজ), ২০% এর বেশি ফল করলে সব পজিশন ক্লোজ।

আমার পোর্টফোলিও পজিশন সাইজিং কেমন হবে???

উইলিয়াম জে ও'নেইল (William J O'Neil) বলেছেন এ রকমঃ ১০,০০০ ডলারের কম হলে ২/৩ টি, ৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত ৪/৫ টি, ৫০,০০০ ডলারের উপরে হলে ৬/৮ টি, আমাদের প্রেক্ষাপটে এমন হতে পারেঃ ১০ লক্ষ টাকার নিচে ৪/৫ টি, ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ৬/৮ টি, ৫০ লক্ষ টাকার উপরে সর্বোচ্চ ১০ টি। তবে এটি কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নয়, আপনি যত দক্ষ ট্রেডার হবেন আপনার পোর্টফোলিও ও তত ডাইভাইর্সিফাইড হবে। কেবলমাত্র হিসাব নিকাশ বা নিয়মিত ট্রেন্ড দেখার বা বুঝার জন্য পোর্টফোলিও সাইজ আপনার সীমার মধ্যে রাখতে পারেন। আমি দেখেছি কেউ কেউ কেবল ১ টা শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন পুরো মূলধন ( সব ডিম এক ঝুড়িতে!!!) আবার কেউ কেউ ৪০ টাতে বিনিয়োগ করেছেন (ডিমের চেয়ে ঝুড়ি বেশি!!!), প্রথমটাতে ঝুঁকি বেশি, দ্বিতীয় টাতে অতি ডাইভার্সিফাইড, আন-ম্যানেজএবল।


আশা করি পজিশন সাইজিং এর কৌশল আপনার কাজে লাগবে।

(চলবে............)

পরবর্তী পর্বঃ স্টপ লস।
Writer : Taj U Ahmed

1 comment: